বাইবেলে প্রায় অনেক জায়গাতেই আমরা দেখতে পাই যে, প্রভু যীশু নিজেকে মনুষ্যপুত্র বলে দাবী করেছেন।

এই ‘মনুষ্যপুত্র’ বা ‘Son of Man’ বা ‘בן–אדם i.e. ben-'adam শব্দের অর্থটা আসলে কি ?

আসুন জেনে নিই সেই বিষয়ে।

        সাধারণত মনুষ্যপুত্র শব্দটি কথ্যভাষায় বেশী ব্যবহৃত করা হত না, কিন্তু প্রভু যীশু নিজের বিষয়ে অনেকবারই এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

মথি ৮ অধ্যায় ২০ পদে লেখা আছে –

যীশু তাঁহাকে কহিলেন, শৃগালদের গর্ত্ত আছে, এবং আকাশের পক্ষিগণের বাসা আছে; কিন্তু মনুষ্যপুত্রের মস্তক রাখিবার স্থান নাই।

এই বাক্যে প্রভু যীশু নিজের বিষয়েই বলছেন, কিন্তু তিনি ‘আমার মস্তক রাখিবার স্থান নাই’ এই কথাটি না বলে ‘মনুষ্যপুত্রের মস্তক রখিবার স্থান নাই’ কথাটি ব্যবহার করেছেন।

এছাড়াও আরও কিছু বাক্য আমরা তুলে ধরছি,

মথি ৯ অধ্যায় ৬ পদে প্রভু যীশু নিজের বিষয়ে বলেছেন –

কিন্তু পৃথিবীতে পাপ ক্ষমা করিতে মনুষ্যপুত্রের ক্ষমতা আছে, ইহা যেন তোমরা জানিতে পার, এই জন্য — তিনি সেই পক্ষাঘাতীকে বলিলেন — উঠ, তোমার শয্যা তুলিয়া লও, এবং তোমার ঘরে চলিয়া যাও।

মথি ১২ অধ্যায় ৪০ পদে প্রভু যীশু নিজের বিষয়ে বলেছেন –

কারণ যোনা যেমন তিন দিবারাত্র বৃহৎ মৎস্যের উদরে ছিলেন, তেমনি মনুষ্যপুত্রও তিন দিবারাত্র পৃথিবীর গর্ভে থাকিবেন।

 

মথি ২০ অধ্যায় ২৮ পদে প্রভু যীশু নিজের বিষয়ে বলেছেন –

যেমন মনুষ্যপুত্র পরিচর্য্যা পাইতে আইসেন নাই, কিন্তু পরিচর্য্যা করিতে, এবং অনেকের পরিবর্ত্তে আপন প্রাণ মুক্তির মূল্যরূপে দিতে আসিয়াছেন।

            নতুন নিয়মে ৮০ বারেরও বেশী ‘মনুষ্যপুত্র’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, অতএব নিশ্চয়ই এই উপাধির একটি গভীর ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অর্থ রয়েছে!

‘মনুষ্যপুত্র’ শব্দের দুটি অর্থ, আর এই দুটি অর্থই অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

                 প্রথম অর্থটি দানিয়েলের ভবিষ্যৎবানীর সাথে সম্পর্কযুক্ত। দানিয়েল ভাববাদী একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন, যার বর্ণনা আমরা দানিয়েল ৭ অধ্যায় ১৩ থেকে ১৪ পদে পেয়ে থাকি, সেখানে লেখা আছে –

13 আমি রাত্রিকালীন দর্শনে দৃষ্টিপাত করিলাম আর দেখ, আকাশের মেঘ সহকারে মনুষ্য-পুত্রের ন্যায় এক পুরুষ আসিলেন, তিনি সেই অনেক দিনের বৃদ্ধের নিকটে উপস্থিত হইলেন, তাঁহার সম্মুখে আনীত হইলেন। 14 আর তাঁহাকে কর্ত্তৃত্ব, মহিমা ও রাজত্ব দত্ত হইল; লোকবৃন্দ, জাতি ও ভাষাবাদীকে তাঁহার সেবা করিতে হইবে; তাঁহার কর্ত্তৃত্ব অনন্তকালীন কর্ত্তৃত্ব, তাহা লোপ পাইবে না, এবং তাঁহার রাজ্য বিনষ্ট হইবে না।

ওপরের ১৩ পদে যে “অনেক দিনের বৃদ্ধ” কথাটির উল্লেখ রয়েছে, সেটি পিতা ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে, যার সামনে এমন একজনকে এনে উপস্থিত করা হচ্ছিল, যিনি মনুষ্যপুত্রের ন্যায় দেখতে ছিলেন, আর ১৪ পদে স্পষ্ট হয় যে, সেই মনুষ্যপুত্র ভবিষ্যতে এই জগতে আসতে চলেছিলেন, যাকে পিতা ঈশ্বর সমগ্র জগতের কর্তৃত্ব দেবেন। সেই মনুষ্যপুত্রের রাজ্য কখনই বিনষ্ট হবে না, তাঁর কর্তৃত্ব অনন্তকাল স্থায়ী হবে।

          ‘মনুষ্যপুত্র’ উপাধিটি আসলে মসীহ বা খ্রীষ্টের একটি উপাধি। প্রভু যীশু যখন নিজেকে মনুষ্যপুত্র হিসেবে দাবী করতেন, তখন তিনি নিজেকে মসীহ বা খ্রীষ্ট হিসেবেও দাবী করতেন।

সেই সময়ের ইহুদী ধর্মগুরুগণ দানিয়েল পুস্তকে বর্ণিত ‘মনুষ্যপুত্র’ উপাধিটির সাথে ভালোভাবেই পরিচিত ছিলেন, তারা জানতেন যে, এই উপাধিটি আসলে মসীহ বা খ্রীষ্টের একটি উপাধি।

প্রভু যীশু নিজেকে মনুষ্যপুত্র হিসেবে দাবী করতেন, তার মুখ্য কারণ ছিল এটাই যে, যাতে ইহুদীরা বুঝতে পারে, তিনিই মসীহ বা খ্রীষ্ট, যার বিষয়ে দানিয়েল ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন।

মথি ২৬ অধ্যায় ৬২-৬৪ পদে লেখা আছে –

62 তখন মহাযাজক উঠিয়া দাঁড়াইয়া তাঁহাকে কহিলেন, তুমি কি কিছুই উত্তর দিবে না? তোমার বিরুদ্ধে ইহারা কি সাক্ষ্য দিতেছে63 কিন্তু যীশু নীরব রহিলেন। মহাযাজক তাঁহাকে কহিলেন, আমি তোমাকে জীবন্ত ঈশ্বরের নামে দিব্য দিতেছি, আমাদিগকে বল দেখি, তুমি কি সেই খ্রীষ্ট, ঈশ্বরের পুত্র?

64 যীশু উত্তর করিলেন, তুমিই বলিলে; আরও আমি তোমাদিগকে কহিতেছি, এখন অবধি তোমরা মনুষ্যপুত্রকে পরাক্রমের দক্ষিণ পার্শ্বে বসিয়া থাকিতে এবং আকাশের মেঘরথে আসিতে দেখিবে

 

ইহুদীরা জানতেন, যে কেউ নিজেকে ঈশ্বরের পুত্র বলে দাবী করেন এবং ঈশ্বরের ডান দিকে বসে থাকার দাবী করেন, সে নিজেকে ঈশ্বরের সমতুল্য করেন।

আমাদের এগুলি বুঝতে হবে যে, যেহেতু যীশু নিজেকে মনুষ্যপুত্র পুত্র বলে দাবী করতেন, সেহেতু তিনি নিজেকে মসীহ বা খ্রীষ্ট হিসেবেও দাবী করতেন, কারণ ‘মনুষ্যপুত্র’ শব্দটি মসীহ বা খ্রীষ্টের একটি উপাধি, যে বিষয়ে আমরা আগেই আলোচনা করেছি। আর মসীহ বা খ্রীষ্ট হয়ে তিনি নিজেকে ঈশ্বরের পুত্র বলেও দাবী করতেন, অর্থাৎ তিনি নিজেকে ঈশ্বরের সমতুল্য করতেন।

·                        ‘মনুষ্যপুত্র’ শব্দটির দ্বিতীয় অর্থ হল - সাধারণ মানুষ বা সাধারণ মানুষের সন্তান।

ঈশ্বর হবার পাশাপাশি প্রভু যীশু সম্পূর্ণরূপে মানুষ ছিলেন।

তো প্রশ্ন আসে এটাই, আমরা কীভাবে জানতে পারি যে, প্রভু যীশু সম্পূর্ণরূপে মানুষ ছিলেন ?

এর উত্তর হল – একজন মানুষের যা কিছু শারীরিক গুণাবলী থাকে, সেগুলি প্রভু যীশুর মধ্যেও ছিল, তিনি আমাদের মতো ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত হতেন, তিনি ক্লান্তও হতেন, তিনি আমাদের মতোই ঘুমোতেন, ইত্যাদি।

যোহন ৪ অধ্যায় ৬ থেকে ৭ পদে লেখা আছে –

6 আর সেই স্থানে যাকোবের কূপ ছিল। তখন যীশু পথশ্রান্ত হওয়াতে অমনি সেই কূপের পার্শ্বে বসিলেন। বেলা তখন অনুমান ষষ্ঠ ঘটিকা।  

এই পদে আমরা দেখতে পাই, যীশু পথশ্রান্ত হয়ে পরেছিলেন, অর্থাৎ পথ চলতে চলতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পরেছিলেন।

7 শমরিয়ার একটী স্ত্রীলোক জল তুলিতে আসিল। যীশু তাহাকে বলিলেন, আমাকে পান করিবার জল দেও।

আর এই পদে আমরা দেখতে পাই, প্রভু যীশু একটি শমরিয়া স্ত্রীলোকের কাছে জল চেয়েছিলেন, অতএব তিনি শারীরিকভাবে তৃষ্ণার্ত ছিলেন।

লুক ২২ অধ্যায় ৮ পদে লেখা আছে –

তখন তিনি পিতর ও যোহনকে প্রেরণ করিয়া কহিলেন, তোমরা গিয়া আমাদের জন্য নিস্তারপর্ব্বের ভোজ প্রস্তুত কর, আমরা ভোজন করিব।

এই পদে আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রভু যীশু পিতর ও যোহনকে ভোজ প্রস্তুত করতে পাঠিয়েছিলেন, অতএব প্রভু যীশু ক্ষুধিতও হতেন।

লুক ৮ অধ্যায় ২৩ পদে লেখা আছে –

কিন্তু তাঁহারা নৌকা ছাড়িয়া দিলে তিনি নিদ্রা গেলেন, আর হ্রদে ঝড় আসিয়া পড়িল, তাহাতে নৌকা জলে পূর্ণ হইতে লাগিল, ও তাঁহারা সঙ্কটে পড়িলেন।

আর এই পদ থেকে আমরা জানতে পারি যে, প্রভু যীশু ঘুমোতেন।

         বাইবেলে আমরা দেখতে পাই, ‘মনুষ্যপুত্র’ উপাধিটি সাধারণ মানুষের জন্যও ব্যবহার করা হয়েছে, যেমনটা যিহিষ্কেল ভাববাদীর পুস্তকে এই উপাধিটি ৯৩ বার ব্যবহার করা হয়েছে। আর এই ৯৩ বার ঈশ্বর যিহিষ্কেলকে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেই পরিচয় দিয়েছিলেন।

উদাহরণস্বরূপ আমরা দেখি যিহিষ্কেল ৪ অধ্যায় ১ পদ, সেখানে লেখা আছে –

আর হে মনুষ্য-সন্তান, তুমি একখানি ইষ্টক লইয়া তোমার সম্মুখে রাখ, ও তাহার উপরে এক নগরের অর্থাৎ যিরূশালেমের ছবি আঁক।

তো ঈশ্বর এখানে যিহিষ্কেলকেই ‘মনুষ্য-সন্তান’ বা ‘son of man’ বলছিলেন।

গননাপুস্তক ২৩ অধ্যায় ১৯ পদে লেখা আছে –

ঈশ্বর মনুষ্য নহেন যে মিথ্যা বলিবেন;

তিনি মনুষ্য-সন্তান নহেন যে অনুশোচনা করিবেন;

তিনি কহিয়া কি কার্য্য করিবেন না?

তিনি বলিয়া কি সিদ্ধ করিবেন না?

 

এখানে ‘মনুষ্য-সন্তান’ শব্দটির ইংরেজী শব্দ হল - ‘son of man’, আর এখানে এই মনুষ্য-সন্তান শব্দটি সাধারণ মানুষ অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে।

গীতসংহিতা ১৪৪ এর গীত ৩ পদে লেখা আছে –

হে সদাপ্রভু, মনুষ্য কি যে তুমি তাহার পরিচয় লও?

মর্ত্ত্যের সন্তান কি যে তুমি তাহাকে গণ্য কর?

 

এখানেও যে ‘মর্ত্ত্যের সন্তান’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটির ইংরেজী শব্দ হল – ‘son of man’ অর্থাৎ ‘মনুষ্য-সন্তান’ বা ‘মনুষ্যপুত্র’।

        এই ধরণের অনেক পদই বাইবেলে রয়েছে, কিন্তু পার্থক্য এটাই যে, ইংরেজী অনুবাদে কোনও সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে ‘মনুষ্য-সন্তান’ বা ‘মনুষ্যপুত্র’ শব্দটি ব্যবহৃত হলে সেখানে পুরো শব্দটিই (son of man) small letter-এ লেখা হত, কিন্তু প্রভু যীশুর ক্ষেত্রে সেই শব্দটির Son-এর ‘S’ (Son of man) Capital অক্ষরে লেখা হত।

এভাবে লেখার কারণ হল – যীশু মানুষ ছিলেন কিন্তু তিনি একজন বিশেষ মানুষ ছিলেন, কারণ তিনি মানুষ হবার পাশাপাশি ঈশ্বর ছিলেন। মানব ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ঈশ্বর-মানব, তাঁর জন্মের বহু পূর্বে বাইবেলের পুরাতন নিয়মে তাঁর বিষয়ে ৩০০-রও বেশী ভবিষ্যৎবাণী লেখা হয়েছিল, যেগুলি তিনি ১০০ শতাংশ পূরণ করেছেন এবং প্রমাণ করেছেন যে, তিনিই মানব রূপে ঈশ্বর।

         প্রভু যীশু ১০০ শতাংশ ঈশ্বর ছিলেন, যিনি সৃষ্টির পূর্বে আদিকাল থেকেই ছিলেন, যেমনটা যোহন ১ অধ্যায় ১ পদে লেখা আছে। এর সাথে সাথে প্রভু যীশু যখন এই জগতে দেহ ধারণ করে এসেছিলেন, তখন তিনি ১০০ শতাংশ মানুষও ছিলেন।

         যদি প্রভু যীশু ১০০ শতাংশ মানুষ না হতেন, তবে তিনি ক্রুশে যে যাতনা ভোগ করেছিলেন, সেটির কোনও মূল্যই থাকত না। প্রভু যীশু সমগ্র মানবজাতির জন্য চাবুকের আঘাত, অত্যাচার ও ক্রুশের যন্ত্রণা একজন সাধারণ মানুষের মতোই ভোগ করেছিলেন এবং অনুভব করেছিলেন।

        মনুষ্যপুত্র হবার দরুন প্রভু যীশুর মধ্যে দুই প্রকারের Nature বা সত্তার অবস্থান ছিল, একটি – দৈবিক বা ঐশ্বরিক সত্তা, আর অন্যটি – মানবিক বা মনুষ্য সত্তা।

বাইবেলে বর্ণিত ঘটনাগুলি থেকে আমরা জানতে পারি যে, প্রভু যীশু মানবিক সত্তাতেই বেশির ভাগ কার্য করতেন, কিন্তু কখনও কখনও তিনি ঐশ্বরিক সত্তাতেও কার্য করতেন, যাতে তাঁর শিষ্যগণ ও সেই সময়ের ইহুদীগণ বিশ্বাস করতে পারে যে, তিনি মনুষ্য রূপে ঈশ্বর ছিলেন। প্রভু যীশু তাঁর পরাক্রমকার্যাবলীর মধ্য দিয়ে নিজের ঈশ্বরত্বের পরিচয় দিয়েছেন।

     তো আশা করছি, আপনারা বুঝতে পেরেছেন যে, প্রভু যীশু নিজেকে ‘মনুষ্যপুত্র’ বা ‘Son of man’ বা ‘בן–אדם i.e. ben-'adamকেন বলতেন।

নিবন্ধটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, জয় যীশু।


Tags:- 

Christian Articles, বাংলা খ্রীষ্টীয় নিবন্ধ, bsbbca, bibleshikshabhaskar, BSB Ministry, Bengali Christian Blog, Bangla Gospel, Bengali Gospel, Preaching in Bengali Language, Bible Based Articles, বাংলা প্রচার, বাংলা যীশুর প্রচার, Bangla Christiyo Christio Khristiyo Khristio Prochar, BSB Gospel, Gospel Articles, Bangla Nibondho, Gospel Online, Online Gospel, বাইবেল প্রচার, বাইবেলের বাক্য, Blogger, Jesus Christ, যীশু খ্রীষ্ট,


0 Comments